Trilochan Shahito Vubon - ত্রিলোচন সাহিত্য ভুবন v
ইচ্ছা - অনিচ্ছা
-শর্মিষ্ঠা
(১)
গভীর রাত। বাইরে শহর-ভাসানো বৃষ্টি। শমীকের ফ্ল্যাটের বেডরুমে রূপমের বুকে মুখ গুঁজে পরম আরামে ঘুমিয়ে আছে পর্ণা। ওর অন্য পাশে শমীক। পরম মমতায় ছুঁয়ে আছে ওকে।নতুন বৌকে পরম সুখ উপহার দিতে পেরে সে তৃপ্ত।
(২)
কলেজ লাইফ থেকে পর্ণা মনে মনে ভালবাসত রূপমকে। প্রোপোজ করা হয়ে ওঠে নি যদিও। রূপম পর্ণার মনের ভাব বুঝেছিল। রূপমের বাবা মা ওদের চার হাত এক করে দেওয়ার প্ল্যান প্রায় করেই ফেলেছিলেন। হঠাৎ করে এক বিয়েবাড়িতে গিয়ে দেনাপাওনা নিয়ে বচসায় পাত্রপক্ষ বর নিয়ে চলে যাওয়ায় লগ্নভ্রষ্টা কনে নীতাকে বিয়ে করে ফেলে রূপম।
 তথ্যপ্রযুক্তিকর্মী পর্ণা এই ঘটনার অভিঘাতে হঠাৎ করে কেমন যেন পাথর হয়ে গিয়েছিল। রূপমের বন্ধু কাম কলিগ শমীক রূপমের মুখে পর্ণার কথা শুনে পর্ণার সঙ্গে বন্ধুত্ব করে ও গুরুজনদের সম্মতিতে রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করে। আগামী মাসে ওদের রিসেপশন।
(৩)
সেদিন সকাল থেকেই আকাশের মুখভার। ডিউটি শেষ করে পর্ণা যখন ফিরছে, অফিস-ক্যাবের চাকা জলে ডুবে অচল হয়ে পড়ল। পথেই শমীকের ফ্ল্যাট। মাকে একটা ফোন করে দিয়ে অগত্যা সেখানেই রাতের মত আশ্রয় নেয় পর্ণা।
(৪)
 " আরে শমু, দেখ দেখ কে এসেছে। আজ কোন দিকে সূর্য উঠেছিল।" শমীকের ফ্ল্যাটের দরজা খোলে রূপম।
 ঘরে মদ ও মাংসের কড়া গন্ধ। দুই পুরুষে ব্যাচেলার পার্টি মানাচ্ছে। নিজের সপসপে ভিজে শরীর নিয়ে বড় বিব্রত বোধ করছিল পর্ণা। রূপম বেশ অনেকখানি পান করেছে ওকে দেখেই বোঝা যায়।
"এস বৌদি। গেস্টরুমে গিয়ে চেঞ্জ করে নাও। শমু কিচেনে ফেঁসে আছে। হাতের কাজ সামলে আসতে সময় লাগবে। "
গেস্ট রুমের ওয়ার্ডরোবে চাবি নেই। ওখান থেকে শমীকের মায়ের একটা নাইটি আর হাউসকোট নিয়ে পরে নেয় পর্ণা। শুকনো হয়ে ভারী আরামবোধ করে। দরজা খুলতেই এক বাটি উষ্ণ সুপ নিয়ে আসে রূপম। "বৌদি, এটা খেয়ে নাও। তোমার হাবি পাঠালেন।"
 " রূপমদা, কলেজে তুমি আমার দু বছরের সিনিয়র ছিলে। প্লীজ আমাকে বৌদি বোলো না।" সসঙ্কোচে কথাটা বলেই ফেলে পর্ণা।
" সম্পর্কের বদলের সঙ্গে সঙ্গে ডাকগুলোও তো বদলে নেওয়া ই ঠিক, ডার্লিং। " কখন যে শমীক ওদের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে ওরা টের ও পায় নি।
"কিন্তু রূপম, আমি তো তোর দাদা নই যে আমার বৌকে বৌদি বলবি। আগের মত নাম ধরেই ডাক, ইয়ার।"
 "পর্ণা, তুমি কি খুব টায়ার্ড? ডিনার দেব খেয়ে শুয়ে পড়বে?"
 " না, তেমন কিছু না।" রূপমের কথার উত্তরে বলে পর্ণা। " কিন্তু কিই বা করার আছে?"
 "আমাদের পার্টিতে যোগ দিলে খুব খুশি হব।"
 (৫)
সঘন গহন রাত্রি
 বহিছে শ্রাবণধারা
 হোম থিয়েটারে জর্জ বিশ্বাসের গলায় রবি ঠাকুরের বর্ষার গান। বেডরুমে খাটের পাশে টি টেবিল টেনে এনে একান্ত আয়োজন। অল্প কিছু স্ন্যাক্সের সঙ্গে পানীয়ের সযত্ন আয়োজন। বিছানায় শমীক- পর্ণা আর মুখোমুখি চেয়ারে রূপম।
পান জীবনে এই প্রথমবার নয় পর্ণার। তবু যে দু পেগের পর চারপাশটাকে এত উজ্জ্বল দেখতে লাগল, তা স্রেফ পরিবেশের গুণ। তৃতীয় পেগের পর শরীর শিথিল হয়ে শয্যার আশ্রয় চাইতে লাগল। টানটান হয়ে বিছানায় শুয়েই পড়ল সে।
 মাথাটা নরম বারমুডা পরা কোলের নিশ্চিন্ত আশ্রয় পেয়ে গেল।
 কিন্তু, শমীকের পরণে তো সুতির পাজামা। তার মানে ওর পাশে...
 "তুমি কখন বিছানায় এলে রূপমদা? " পর্ণা অবাক হয়ে জানতে চাইল।
"অ্যাকচুয়ালি, একটু রিল্যাক্স করার জন্য খাটে বসেছিলাম। তুমি মাথাটা তোলো, সরে যাচ্ছি।"
 " আরে না না, বোস তুই। পর্ণা তো একটু পরেই উঠে পড়বে। কি পর্ণা, আর এক পেগ নেবে তো?"
পর্ণার শরীর তখন চায় একটু আরাম। কথা বলার মত ইচ্ছেটুকুও হচ্ছে না। রূপমের উরুতে আরও বেশি করে মুখ গুঁজে শুয়ে থাকলো ও।
"এই পর্ণা, তুমি রূপমকে ভালোবাসো?"
 " কি হচ্ছে কি শমু, নিজের বউয়ের কাছে এমন কথা কেউ জানতে চায়?" শমীককে বকে থামাতে চায় রূপম।
"সবই তো তুই জানিস, বল? কেন লুকোনো ঘা টাকে খুঁচিয়ে দগদগে করছিস? জানিস, আমার বৌ সেদিনের সেই অপমান আজও ভুলতে পারে নি। আমার ঘরে এসে সুস্থভাবে ঘর পর্যন্ত করতে পারছে না। বাপের বাড়ি পালাতে পারলে বাঁচে। জানি না কতদিনে ঠিক হবে। তুই পর্ণাকে পেয়ে সুখি হ শমু। এসব কথা ভুলে যা, প্লীজ।"
 "দুর বোকা, ভুলে যাওয়ার কি হয়েছে? ভালোবাসতিস, ভালেবাসবি। তোর মানুষ তোরই আছে। সংসার আর সমাজ বাঁচিয়ে যা প্রাণ চায় করে নে। নাও পর্ণা, নিজের মানুষকে নিজের মতো করে কাছে টেনে নাও।"
 "কিন্তু" পর্ণা বলে, " আমার ভালোবাসার মানুষ এক নয়, দুই। রূপমদাকে কখনো বলতে পারি নি, কিন্তু তোমাকে তো কতবার সোচ্চারে বলেছি। সেই রেজিস্ট্রেশন এর দিন তোমার হাত থেকে আঙটি পরা, সেই রাতে দুই বাড়ির যৌথ ব্যবস্থাপনায় এই ঘরে এই বিছানায় সারপ্রাইজ নাইটে প্রথম সহবাস, দু জনে মিলে বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য শপিং, তারপর চোখের আড়াল হলে ফোন বা হোয়াটসঅ্যাপ- সব সময় জোর গলায় তোমাকে ভালোবাসার কথা বলেই চলেছি।
 অতএব যা প্রাণ চায় তাই করতেই হলে আমি একসঙ্গে দু জনকে ভালোবাসব।"
 "কথাটা সজ্ঞানে বলছ তো পর্ণা?" জিগ্যাসা ওদের দুজনের।"হ্যাঁ, তোমাদের কাছে এই রোমান্টিক রাতে আমার এটাই চাওয়া। বলো, দেবে?"
শমীকের হাতটা আলতো করে ধরে কাছে টেনে নেয় রূপম। মুখ নিচু করে পর্ণার ঠোঁটে চুমু খায়।
(৬)
রাত প্রায় শেষ হয় হয়।পর্ণা এখনো তৃপ্তির ঘুমে আচ্ছন্ন। সদ্য ঘুম ভাঙা দুই পুরুষ সে দিকে তাকিয়ে একটা কথাই ভাবছে। সদ্য পেরিয়ে আসা বর্ষার রাত, তার স্বর্গীয় অনুভূতিগুলো, সম্পর্কের মধুর পবিত্রতা, সব সম্ভব হয়েছে এই নারীর অনুমোদনের ওপর। ঘটনাটি তার অনিচ্ছায় হলে এই একই ঘটনার ওপর পড়ে যেত গণধর্ষণের কলঙ্কের ছাপ। এই একই মেয়ের মুখের অপার্থিব সুখ বদলে যেত অন্তহীন যন্ত্রণা ও অপমানের গ্লানিতে। প্রিয়তমার ঘুমন্ত শরীর ছুঁয়ে শান্তি পাওয়ার বদলে দুজনের স্থান এতক্ষণে হত থানার লক আপের নরকে।
 পৃথিবীর কিছু কিছু ব্যাপার সত্যিই ভারী অদ্ভূত।

No comments:

Post a Comment