Trilochan Shahito Vubon - ত্রিলোচন সাহিত্য ভুবন: November 2020 v

 "ল এ লাঠালাঠি"

 -- অরবিন্দ সরকার


লাভপুরের লায়েবপাড়ায় লেঠেল পট্টির বাস।

লাখোপতি লোকেদের লালিত তারা, লোকজনের ত্রাস।

লোচনচরণ,লোভরঞ্জন,দুই ভাই তাঁরা লম্পট।

লোলুপ দৃষ্টি লহমায় লাবনীর দিকে,ললনার সঙ্কট।

লোকভাষা বোঝা দায়, চেহারায় লম্বোদর।

লটপটে নয় তারা লম্বা চওড়ায়,

লড়াকু লম্ফঝম্প বাঁদর।

লজ্জা শরমের লণ্ডভণ্ড,শিক্ষায় লবডঙ্কা।

গৃহে লণ্ঠন জ্বলে, পাড়ায় লুটোপুটির আশঙ্কা।

লব্ধপ্রতিষ্ঠ, লস্কর,লায়েক কাবু লাঠির আগায়,

লাগানিভাঙানি ললাটলিখনি,তাতে লাগাম নাই !

লাঞ্ছিত লোক লুঙ্গি ল্যাঙ্গট পরিধানে লাগাড় লাইনে,

লুক্কায়িত ক্ষোভ! লোভ লালসার অবসানে,

লুটপাট লুণ্ঠন লাখোপতির প্রাসাদে, লাঠালাঠি শুরু,কালিলেপন লোকলীলার স্বাদে।

ভূলুণ্ঠিত লাখোপতি, লোকান্তরে লাঠিয়াল,

লাফালাফির লাথি,লগুড়ে বিনাশ,লায়েবপাড়ায় শান্তি চিরকাল।

 যত্ন

হমায়ূন কবীর


-কোথায় যাবেন? 

ইমা গাড়ির ড্রাইভার গাড়ির পেছনে বসা যাত্রীর কাছে জানতে চাইলো। 

যাত্রী লোকটা উত্তর দিলো,জামতলা। না। না,না। রঘুনাথ পুর। জামতলা, না। জামতলা তো বোনের বাড়ি,রঘুনাথপুরের আগে। আমি যাবো শালির বাড়ি রঘুনাথপুর। আমাকে জামতলায় নামিয়ে দিবে। না,না রঘুনাথ পুর। ভাড়া কতো ?

-দশ টাকা। ঠিক করে বলেন । 

-ওরে ভাই, হ্যা, রঘুনাথপুর যাবো। না,জামতলা। না,রঘুনাথপুর। 

কথা বলতে বলতে সে ভাড়া অগ্রিম মিটিয়ে দিলো। 

আমি বললাম,জামতলায় রক্ত পড়ে গেলো। 

লোকটা বললো,ও পড়ুক। ও রক্ত নষ্ট হবে না। ভাই-বোনের সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার জিনিস না। গত সপ্তায় বোনের বাড়ি থেকে ঘুরে গিয়েছি। আজকে কি আর যাওয়া যায়? কিন্তু মন চলে যাচ্ছে। 

-তাহলে জামতলা? 

-হ্যা, জামতলা। না,না রঘুনাথপুর। অনেকদিন যাওয়া হয়নি। 

ড্রাইভার আমাদের কথা শুনছিলো। সে বিরক্ত হয়ে বললো, এই আপনি কোথায় যাবেন ঠিক করে বলেন। 

আমি বললাম,আপনার মন তো জামতলায় বোনের বাড়ি চলেগেছে। কিন্তু আপনি বাধ্য হয়ে শালির বাড়ি যাচ্ছেন। 

গাড়িতে আমার পাশের সিটে একজন বাউল একতারা হাতে চুপচাপ বসেছিলো। একতারায় টুং করে একটা শব্দ করে হো,হো করে হেসে উঠলো। গাড়ির সব যাত্রী হা,হা করে হাসতে লাগলো।  


গাড়িতে প্রয়োজনীয় যাত্রী উঠেগেছে, গাড়ি চলতে শুরু করেছে। লোকটা কিছুক্ষণ ভেবে হঠাৎ বলে উঠলো হ্যা,রঘুনাথপুর। বোনের বাড়ি জামতলায় যেয়েযেয়ে অভ্যাস হয়ে গেছে তাই বারবার ঐ নামটাই মুখে চলে আসছে। আসলে আমি যাবো রঘুনাথপুর। শালি জুতা কিনে দেবে বলেছে। 

আমি বললাম,ও তাই এতো যত্ন? 

-মানে? 

-না,ত্রিশ টাকা দামের এক আটি পুইশাক, দুইশো টাকা দামের নতুন গামছা দিয়ে ঢেকে কোলে তুলে রেখেছেন। এই করোনার দিনে মানুষ নিজের অসুস্থ মাকে রাস্তায় ফেলেদিচ্ছে আর আপনি সামান্য পুঁইশাক কোলে তুলে যত্ন করছেন। কেনো? পুঁইশাকের যাতে করোনা না হয় সেইজন্য? 


গাড়ির সবাই আবারো হেসে উঠলো। লোকটা কিন্তু মোটেও হাসলো না। সে আমাকে উল্টো প্রশ্ন করলো, আপনার কপালে চোখ আছে? কী রোদ দেখেছেন? মানুষ পর্যন্ত পুড়ে যাচ্ছে। ঢেকে না রাখলে এগুলো এতক্ষণ শুকিয়ে চুপসে যেতো। যত্ন করে রেখেছি বলেই এগুলো এখনো এতো সুন্দর তাজা আছে।মানুষ যারা তারা মাকে তো ভালোবাসেই বাড়ির পশুপাখি গুলোও ভালোবাসে, সবকিছু যত্নে রাখে। মায়ামমতা সবার ভিতর থাকে না। শালির বাড়ি কোনোদিন পুঁইশাক নিয়ে গেছেন? 


-না। আমি শালির বাড়ি গেলেও মিষ্টি,ফল এগুলো নিয়ে যায় আবার বোনের বাড়িও একইরকম। 

-ওরে ভাই, বাজারের ওসব তো ভেজাল,বিষাক্ত যে খাবে তারই ক্ষতি। সবকিছু সবাই বোঝে না। এইরকম টাটকা জিনিস কোথায় পাবেন? এ আমার উঠানে লাগানো সার-তেল ছাড়া খাটি যত্নের পুঁইশাক। 


লোকটার বামপাশে, আমার ডাইনে এক চাচা বসে আছে। সে একটিন ভর্তি নোনামাছ নিয়ে কালিগঞ্জের বাজারে বিক্রি করতে যাচ্ছে। রঘুনাথপুর পার হয়ে আমরাও সপরিবারে কালিগঞ্জ যাবো শালির বাড়ি। 


নোনামাছ ওয়ালা চাচা বললো,হ্যা, পুইশাক খুব সুন্দর। এর সাথে নোনামাছ হলে একেবার জমে যাবে। নোনামাছ নিয়ে যাও। 


-নোনামাছ নিতাম কিন্তু রঘুনাথপুরের লোকজন মাছ খায় না। 


চাচা বললো,মিথ্যা কথা। টাকা খরচের ভয়ে ঐগুলো বলছো? শুধু পুইশাক নিয়ে যাও দেখো শালি জুতো কোথায় দেয়। 


-ওরে চাচা,তুমি মনে করেছো শুধু পুঁইশাক নিয়ে যাচ্ছি? এই দেখো প্যাকেট। প্যাকেট ভর্তি বেগুন।পাঁচ কেজির কম না। বেগুন এখন বাজারের সবচে দামি তরকারি। তাওতো সার-তেলের বিষ। আর এ নিজের ক্ষেতের সার তেল ছাড়া শুদ্ধ-পবিত্র বেগুন। বেগুন,পুইশাক,কচু আর নোনামাছ।আহ্! একসাথে রান্না করলে মুড়োঝাটা আর ছেঁড়া জুতা নিয়ে বসতে হবে। 


আমি বললাম,আবার ছেঁড়া জুতা কেনো? 

-ও আপনি বুঝবেন না? 

-কেন, বুঝবো না কেন? 

-বুঝলে শুনেই বুঝতেন। 

আমাদের কথা শুনে বাউল আবারো টুং করে একতারায় শব্দ করলেন। তারপর হেসে বললেন,বেগুন,পুঁইশাক,কচু আর নোনামাছ একসাথে রান্না করলে এত সুন্দর টেস্ট হবে যে, ভাত-তরকারি শেষ হয়ে যাবে তবু মুখ বলবে -আরো দাও,আরো দাও। তখন ঐগুলো দিয়ে সাদের ভুত ছাড়াতে হবে। 


লোকটা বললো, ঠিকঠিক। কিন্তু আমার শালিরা মাছ খায় না। 


আমরা তার কথা কেউ বিশ্বাস করলাম না। 


কথায় কথায় গাড়ি জামতলায় চলে এলো। গাড়ি থামিয়ে ড্রাইভার বললেন,ঐ ভাই, নামেন। 


লোকটা বললো,ওরে ভাই, আমি তো বলেছি আজ বোনের বাড়ি যাবো না। প্রয়োজনে শালির বাড়ি থেকে ফেরার পথে বোনের বাড়ি যাবো। 


গাড়ি ছেড়ে দিলো। জামতলা থেকে একজন লোক উঠেছে। সে ঐ পুঁইশাক ওয়ালা লোকটার পাশে বসতে চায়। 

পুঁইশাক ওয়ালা বললো,ভাই আপনি আমার সামনের সিটে বসেন। এখানে বসলে আমার পুঁইশাকের ডগা ভেঙে যাবে। দেখছেন না যত্ন করে কোলের উপর ঢেকে রেখেছি। 

-সামান্য পুঁইশাকের এতো যত্ন? ওগুলো পুঁইশাক না তোমার সন্তান। মনে হচ্ছে শালির বাড়ি যাচ্ছো। 

-হ্যা এগুলো আমার সন্তানের মতোই যত্নের জিনিস।আত্মীয়কে আত্মার নিখুত জিনিসটাই দিতে হয়। 

কথা বলতে বলতে লোকটা পুঁইশাকগুলো আরও একটু যত্ন করে কোলের কাছে টেনে নিলো। ততক্ষণে নতুন যাত্রীটি পুঁইশাক ওয়ালার পাশে বসার জন্য সরে এসেছে। চাপাচাপিতে কয়েকটা পুঁইশাকের ডগা ভেঙে গেলো। গাড়ির যাত্রীরা হাহাকার করে উঠলো

পুঁইশাক ওয়ালার মুখ কষ্টে কালো হয়ে গেলো। সে খুব কষ্ট পেয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে পুঁইশাকের ডগা না ওর বুকের কয়েকটা হাড় ভেঙেগেছে। 


গাড়ি রঘুনাথপুর চলে এসেছে। ভাড়া আগেই দেওয়া ছিলো। লোকটা নেমে পুঁইশাক ভেঙে দেওয়া লোকটার দিকে টলমল চোখে তাকিয়ে আছে। আমারও খুব কষ্ট লাগছে। ওর ব্যাথাটা আসলে কেউ বুঝতে পারছে না। মানুষের ভিতর থেকে যত্ন ব্যাপারটা উঠেগেছে তো। ইচ্ছে করছে লোকটাকে দুটো শান্তনার কথা বলি। পথে তার সাথে কতো মজা করেছি। এখন কষ্টের সময় তাকে কিছু না বলে চলে যাবো? 


গাড়ি আবার চলতে শুরু করেছে। আমি লোকটার দিকে তাকিয়েই আছি। লোকটা তখনও মনখারাপ করে দাড়িয়ে আছে। আমার মনে হলো ওর চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। সামান্য পুঁইশাকের জন্য কান্না! না আমি ভুলও দেখতে পারি। অবশ্য পৃথিবীর সব মানুষ তো আর একরকম না।